মোস্তফা ইউসুফ/ঢাকা
জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতিতে প্রায় দুই যুগের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সাথে বিএনপির মতবিরোধ ও বিভাজন প্রকট হয়ে উঠছে। গত ৫ আগস্টের আগে এই দুটি দল দীর্ঘসময় ধরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের লক্ষ্যে আন্দোলন করেছে।
দুই দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা, সংস্কার ও নির্বাচন, ভারতের সাথে সম্পর্ক, প্রশাসন ও পুলিশে দলীয় অনুগত লোকদের নিয়োগসহ বেশকিছু বিষয় নিয়ে বাগযুদ্ধ চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দল দুটির বিপরীত মেরুতে অবস্থান দেখতে পাচ্ছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বেনারনিউজকে বলেন, “বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এ বিভাজন কতটা রেটোরিক (কথায়) আর কতটা সাবস্টেনশিয়াল (বাস্তব) সেটা সময় বলে দেবে। ”
“এটা কতদূর গড়াবে সেটা এখনই বলা ডিফিকাল্ট (কঠিন)। তবে আমি মনে করি জামায়াত সুদূরপ্রসারী কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। সংস্কারের ভেতর দিয়ে ছাত্র-জনতার বিপ্লবে যে আশা-আকাঙ্ক্ষা সেটা সামনে রেখে তারা অগ্রসর হচ্ছে। বিএনপির চেয়ে কৌশলগতভাবে তারা অনেকটা এগিয়ে গেছে বলেও মনে হচ্ছে,” বলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বেনারনিউজকে বলেন, জামায়াত আমাদের একসময়ের মিত্র। আমাদের জোট বিলুপ্ত হওয়ার পর তারা অনেক আন্দোলন-সংগ্রামে ছিল না, বিএনপি একাই লড়াই করেছে।
“জামায়াত ইসলামী আমাদের সাথে যুগপৎ আন্দোলনেও ছিল না। তবে, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আমাদের কর্মসূচির সাথে মিল রেখে তারা অনেক কর্মসূচি দিয়েছে, সেক্ষত্রে তারা আমাদের রাজপথের সঙ্গী,” বলেন তিনি।
সালাহউদ্দিন বলেন, জামায়াত ইসলামীর আদর্শ, রাজনীতি ও নির্বাচনী কৌশল আলাদা। তারা কিভাবে নির্বাচন সামনে রেখে বক্তৃতা-বিবৃতি দেবে, সেটা তাদের কৌশল।
“বিএনপির সাথে মিল-অমিলের কোন প্রশ্ন নেই। তবে সব বক্তব্য সিরিয়াসলি ধরে সেটা দিয়ে রাজনীতির মধ্যে একটা অবস্থান নির্ধারণ করারও যুক্তি নেই। আমরা রাজপথে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ছিলাম। জাতীয় ঐক্য নষ্ট হয় এমন কিছু আমরা চাই না,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবর রহমান বেনারনিউজকে বলেন, বিএনপির সাথে আমাদের সম্পর্কের কোন অবনতি ঘটেনি। সম্পর্ক যা ছিল তাই আছে।
তিনি বলেন, “যারা একাত্তরে জামায়াতকে দোষী সাব্যস্ত করার মনোভাব থেকে বক্তব্য রাখেন ওনারা (বিএনপি) তো ১৯৯১ ও ২০২১ সালে জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করেছিলেন। ওনাদের দৃষ্টিতে যদি জামায়াত দোষী হয়ে থাকে, তাহলে তাদের সমর্থনে সরকার গঠন করে নিজেরাও দোষ করলেন।
ওনারা জামায়াতে ইসলামীকে দোষ দেবেন, আবার জামায়াতের সমর্থনে সরকারও গঠন করবেন-এই দ্বৈততা কেন?-প্রশ্ন রাখেন তিনি।
মুজিবর রহমান প্রশ্ন রেখে বলেন, “ওনারা জামায়াতের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনছেন সেগুলো আনছেন ২০২৫ সালে এসে। ২০০১ সালে জামায়াতকে সাথে জোট চারদলীয় জোট গঠন করার সময় কি এটা মনে ছিল না। এরপর যখন সরকার গঠন করল জামায়াত থেকে দুজনকে ক্যাবিনেটে নিলেন কেন?”
তিনি বলেন, দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য জামায়াতের দরকার। আবার স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে তখন আর জামায়াতের দরকার নাই। বিএনপির এ চরিত্রটা জনগণ ঠিকই বুঝতে পারছে”।
বিএনপি-জামায়াতের এই দূরত্ব প্রসঙ্গে সেন্টার ফর গভর্নেস স্টাডি’র নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বেনারকে বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের অনেক আগে থেকে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। বিএনপিতে দুটি ধারা সবসময় ছিল; মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বা বিপক্ষের। এখন মনে হচ্ছে, বিএনপিতে দুটি পক্ষই জামায়াত ইস্যুতে একই অবস্থানে আছে। মনে হয় না বিএনপি আর জামায়াতকে সাথে নিয়ে চলবে।”
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছে। যদিও বিএনপি সবসময় দাবি করত তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দল ও মাঠে যারা যুদ্ধ করেছে সেই সংখ্যাটা তাদের দলে বেশি। জামায়াত থেকে সরে গেলে বিএনপি’র সেই দাবি জোরদার হবে এবং বিএনপি’র জন্য সেই সুযোগ তৈরি হয়েছে।
“বিএনপি বরং যেভাবে শুরু হয়েছিল একটা মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল হিসেবে, সেই ধারাতেই থাকতে চাইবে। এখনকার বাস্তবতায় ডান বা বাম কারো সাথে বিএনপি আর সখ্যতায় যেতে চাইবে না,” মনে করেন জিল্লুর।
বিরোধের কেন্দ্রে সংস্কার না নির্বাচন
জামায়াত সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের পক্ষে, অন্যদিকে বিএনপি জরুরি কিছু সংস্কারের পাশাপাশি দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছে।
অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী তার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, “বিএনপি’র দ্রুত নির্বাচন চায়, এখনই সংস্কার তাদের কাছে মুখ্য নয়। বিষয়টি জনগণ পছন্দ করছে না। সবাই আগে মৌলিক কিছু সংস্কার চায়। কারণ আমরা আগের অবস্থায় আর ফিরতে চাই না। ”
“বিএনপি যেহেতু বড় দল, তারা মনে করছে যত দ্রুত ইলেকশন হবে, তত বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। যত দেরি হবে নানা সমীকরণে সেটা কমে আসতে পারেও বলে দলটি মনে করছে। আমি মনে করি তাদের এই কৌশল ঠিক না,” বলেন তিনি।
তবে বিএনপির দ্রুত নির্বাচন চাওয়ার বিষয়ে জিল্লুর একমত পোষণ করে বলেন, “আমি অনেক আগে থেকে ইলেকশনের পক্ষে। সরকার যদি খুব ভালো পারফর্ম করতে পারত, তাহলে মানুষ অনেক সময় দিত। বিশেষ করে আইন-শৃংখলা, দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা আছে।”
তিনি যোগ করেন, “এ ধরনের অস্থির অবস্থার মধ্যে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করছেন না, বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো এগিয়ে আসছে না।
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে জামায়াত ও বিএনপি একমত হতে পারছে না কেন জানতে চাইলে অধ্যাপক মুজিবর রহমান বলেন, “আমরা উভয়ে নির্বাচন চাই। চাওয়ার মাঝখানে আছে সংস্কার। নির্বাচন পদ্ধতির কিছু পরিবর্তন দরকার। ”
তিনি বলেন, “আমাদের একটা দাবি হলো পর পর দুবার কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। একই ব্যক্তি একই সাথে সংসদ নেতা ও দলের প্রধান হতে পারবেন না। এসব করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াও সরকারকে সময় দিতে হবে।”
ভোটের মাঠে বিএনপি জামায়াতের প্রতিদ্বন্দ্বি হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা বলেছি। আবার আমাদের একটা প্রস্তাব হলো সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা। আবার সরকারের সংস্কার কমিটির প্রস্তাব হলো দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ। এসব বিষয়ে সমাধানে আসতে সময় লাগবে।”
অন্যদিকে বিএনপি বরাবরই দ্রুত নির্বাচন চেয়ে আসছে।
কেন তাঁরা দ্রুত জাতীয় নির্বাচন চাইছে-এর ব্যাখ্যা দিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, নির্বাচন যদি দ্রুত না হয়, সময়ক্ষেপণ করা হয়, তাহলে অন্যান্য শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। তখন জনগণের যে চাহিদা, সেই চাহিদা থেকে তারা পুরোপুরিভাবেই বঞ্চিত হয়।”
Copyright ©2015-2024, BenarNews. Used with the permission of BenarNews.