জিয়া চৌধুরী/ঢাকা

ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনাকে ”অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত” উল্লেখ করে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যেকে দায়ী করে বিবৃতি করে দেয় অন্তর্বতীকালীন সরকার।
দশ ঘন্টা পর আরেকটি বিবৃতিতে, সারাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে অন্তর্বতী সরকার।
বৃহস্পতিবার রাতে দেয়া এই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রস্তুত। কোনো ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হলে দায়ী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেবে এবং দোষীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ভারতে অবস্থানরত ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।

তিনি বলেন, ঢাকা এর আগে শেখ হাসিনাকে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া থেকে বিরত রাখতে নয়াদিল্লির প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল, কিন্তু আমরা কোনো সাড়া পাইনি।
হোসেন বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার আবারও ভারতীয় ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার পবন বাধের মাধ্যমে তাদের আপত্তি জানিয়েছে।
এদিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি ধ্বংস করে দেয়ায় নিন্দা জানিয়েছে ভারত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এই নিন্দা জানান।
রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই বলছেন, অন্তবর্তী সরকার এসব ঘটনা বন্ধে একদিকে ব্যর্থ হয়েছে, আরেকদিকে ঘটনার পর এর নিন্দা পর্যন্ত জানায়নি।
উল্লেখ্য, গত বুধবার রাতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে আগুন লাগানো হয়। ভাঙচুর চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। এর আগে গত ৫ আগষ্ট আগুন লাগালে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের আসবাব, নথি ও বইপত্র পুড়ে যায়।
এ ছাড়া শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বাসভবন সুধা সদনেও আগুন লাগানো হয়।
এরই মধ্যে দেশের কয়েকটি স্থানে ওবায়দুল কাদের, আমির হোসেন আমু, শাহরিয়ার আলম, শেখ হেলালসহ কয়েকজন নেতার বাসা-বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়, আগুন লাগানো হয়।
বিশৃঙ্খলার জন্য সরকারের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বেনারকে বলেন, “জাদুঘরে বুলডোজার কিভাবে গেল সেখানে, সরকারকে তা খতিয়ে দেখা উচিত। উল্টো তারা বিবৃতি দিলেন, এরকম ঘটনা আর দেখতে চান না। তাদের [অন্তবর্তী সরকার] তো উচিত ছিল শুরুতেই এটা মোকাবিলা করা। উল্টো বুলডোজার পাঠিয়ে দেয়া হলো। ”
এই ঘটনায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুবই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে বলে জানান মান্না।
ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি ভাঙ্গার জন্য এক্সক্যাভেটর আনার বিষয়ে কিছু জানাতে পারেনি পুলিশ।
ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী আহমেদ মাসুদ বেনারকে বলেন, “সেখানে পুলিশ কোনো পাহারা-টহলে নেই। তাই কারা এক্সক্যভেটর এনেছেন বা কোথা থেকে এনেছেন আমরা বলতে পারবো না।
গতকাল বুধবার রাতে স্মৃতি জাদুঘরের সামনে স্লোগানে সক্রিয় ছিলেন ইনকিলাব মঞ্চের সংগঠক শরীফ ওসরান হাদি। তিনি বুধবার রাতে বেনারকে বলেন, “এক্সক্যভেটর আসার খবরে আমরা কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে যাই, সেখানে ওটা পাইনি। পরে আসাদ গেটের দিক থেকে একটি এক্সক্যভেটর মেশিন নিউমার্কেটের দিকে যেতে চাইলে জনগণ এটিকে ধানমণ্ডি ৩২-নম্বরে নিয়ে যায়। পরে শেষ রাতে আরো একটি এক্সক্যভেটর আনা হয়। কোথা থেকে এগুলো এসেছে আমরা ঠিক বলতে পারছি না।”
এ প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্না আরো বলেন, “সরকার যদি এভাবে এটাতে[ হামলা-ভাঙ্চুরে ইনভলভ হয়ে যায় সেটা খুবই দুঃখজনক। এটা রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পথকে বাধাগ্রস্ত করবে। এরকম পথ থেকে সরকারকে দ্রুত সরে আসা উচিত।”
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি আরও বলেন, “আমিও জেল-জুলুমের শিকার হয়েছি। এখন প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু করলে তো আর এগোতে পারবো না। “তবে, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর দলকে দুষছেন মান্না। তিনি বলেন, “ওনার [হাসিনার] কি দরকার এরকম উল্টা-পাল্টা বক্তব্য দেওয়ার?”
রাজনৈতিক নেতাদের ভাবনা
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ধানমন্ডি-৩২ নম্বর বাড়ি এবং অন্যান্য স্থাপনায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর পেছনে একটি চক্র থাকতে পারে, যারা দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং বিশৃঙ্খলা তৈরির উদ্দেশ্যে কাজ করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে এসব হামলা-অগ্নিকান্ডের জন্য দায়ী করে হাফিজ উদ্দিন বলেন, সরকার দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথ প্রশস্ত করবে বলে তার প্রত্যাশা।
ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা নুরুল হক নুর বলেন, “এখানে মনে হয় সরকারের ভেতর থেকে সমর্থন রয়েছে। না হলে তো এভাবে পূর্ব ঘোষণা দিয়ে এভাবে পাবলিককে উত্তেজিত করে অস্থিরতা তৈরি করা সম্ভব নয়। এটা তো সরকারের ভেতরের সমর্থন ছাড়া হওয়ার কথা নয়।”
একইসঙ্গে উপদেষ্টাদের দিকে আঙুল তুলে তিনি বলেন, “সরকারের উপদেষ্টাদের কারও কারও ফেসবুকে আমরা এই ঘটনার প্রতি সমর্থন দেখেছি। সরকার যদি এই ধরনের কর্মকাণ্ডে সমর্থন দেয়, তাহলে তো নৈরাজ্য তৈরি হবেই।”
এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে বাম গণতান্তিক্রক ফ্রন্ট ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলসহ বিভিন্ন সংগঠন।
এদিকে বুধবার সকালে দেয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসে সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, উৎসব হোক!

যদিও সরকারের আরেক গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, বৃহস্পতিবার রাতে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, থামুন! শান্ত হোন। সরকারকে কাজ করতে দিন।
স্ট্যাটাসে তিনি আরও উল্লেখ করেন, হঠকারিতা করবেন না। অভ্যুত্থানের ফসল নষ্ট করবেন না। শত্রুরা আপনাদের যেভাবে দেখতে ও দেখাতে চায়, সেপথে না যাওয়াই এদেশের জন্য ভালো।
আগুনের ঝুঁকিতে ছিল আবাসিক ভবন
এদিকে ধানমন্ডি ৩২-এ মুজিব জাদুঘরে আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনার মধ্যেই রাত পৌনে এগারোটার দিকে ধানমন্ডি-৫ নম্বরে শেখ হাসিনার পারিবারিক বাড়ি ‘সুধা সদন’-এ আগুন দেয়া হয়।
সুধা সদনের পশ্চিম পাশের আবাসিক ভবনেও আগুনের ঝুঁকিতে বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাস্তায় এসে নামেন ওই বাড়ির বাসিন্দারা।
আবাসিক ভবনটির নিরাপত্তাকর্মী মো. জামাল বেনারকে বলেন, আগুন দেয়ার পর এক ঘণ্টা ধরে অন্তত ১৬ বার ফায়ার সার্ভিসকে ফোন করলেও তারা আগুন নেভাতে যায়নি।
“কল করার পর সুধা সদনের কথা শুনলে ফোন কেটে দেন তারা। শেষমেষ একজন ফোন ধরে বলেন, ওখানে [সুধা সদনে] আগুন নেভাতে গেলে হামলার মুখে পড়ার সম্ভাবনা আছে।”
মধ্যরাতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে মিস্ত্রি এনে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পাশের বাড়ির বাসিন্দারা।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঘটনাতেও বেশ কয়েকজন জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে আগুন নেভানোর আহ্বান জানালে ঘটনাস্থলে যায়নি ফায়ার সার্ভিস।
বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য জানতে চাইলে কোন প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজি হননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
Copyright ©2015-2024, BenarNews. Used with the permission of BenarNews.