কামরান রেজা চৌধুরী/ঢাকা

লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার এক দশক পার হলেও বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার স্বাধীনতার পরিবেশ উন্নত হয়নি বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মী এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের সদস্যরা।
এমনকি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে সহিংস চরমপন্থার ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ, সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকারের নেওয়া নীতিগুলো ভুল ছিল, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও জঙ্গিদের হাতে খুন হওয়া প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের বাবা আবুল কাশেম ফজলুল হক বেনারকে বলেন, “বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষতা চিন্তা চর্চার পরিবেশ নেই। দশ বছর আগে এই চিন্তা চর্চার পরিবেশ খুব খারাপ ছিল। ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়। তাঁর বই প্রকাশ করার কারণে দীপনকে হত্যা করা হয়। তাদের কী অপরাধ ছিল?”
তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পর থেকে কিছু বামপন্থী রাজনীতিবিদ এবং বিতর্কিত বুদ্ধিজীবী ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচারের নামে ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলে ইসলামী দলগুলোকে আক্রমণ করেছেন। যার ফলে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি বিতর্কিত হয়ে উঠেছে।”
অধ্যাপক কাশেম বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বুঝিয়েছেন, রাষ্ট্র কোনো ধর্মের পক্ষে যাবে না। সকল ধর্মের সমান সুযোগ থাকবে। কিন্তু সেটিকে জনপ্রিয় করা যায়নি।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে ইসলামী দলগুলো বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে অবস্থা।”
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি প্রাঙ্গণে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান ব্লগার ও মুক্তচিন্তক অভিজিৎ রায়কে। স্বামীকে রক্ষা করতে গিয়ে হাতের আঙুল হারান স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।
সে বছর ৩১ অক্টোবর আজিজ সুপার মার্কেটে কুপিয়ে হত্যা করা হয় দীপনকে।
অভিজিতের ভাই অনুজিৎ রায় বেনারকে বলেন, “আগের পরিবেশ (আওয়ামী লীগ আমলের) নিঃসন্দেহে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা ও মত প্রকাশের জন্য ভালো ছিল না। কিন্তু বর্তমানে অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে।”
তিনি বলেন, “আমি জানি না এবার কোনো সংগঠন অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করবে কি না। যদি করে তবে আমি অংশ নেব। যদি না করে তবে প্রতি বছরের মতো বাড়িতে নিজেরা পালন করব।”
অনুজিৎ রায় বলেন, “আপনি বোঝেন (সহিংসতার) ঝুঁকি বেড়েছে। নিজের প্রাণ রক্ষা তো আগে!”
প্রতিবছর অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রতিবাদ জানিয়ে আসা আনন্দম প্রকাশনীর প্রকাশক মুক্তা মজুমদার শ্রাবণী বেনারকে জানান, “এবারও সেটা অব্যাহত থাকবে। না করলে ওরা মনে করবে ভয় পেয়েছি। ”
ফিরে দেখা জঙ্গিদের আক্রমণ
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর কালশীর পলাশনগরে নিজ বাড়ির সামনে ব্লগার রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যার মাধ্যমে ব্লগার হত্যা শুরু হয়। আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে কমপক্ষে ১১ ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তি, ট্রান্সজেন্ডার অধিকার কর্মীকে হত্যা করে জঙ্গিরা।
তদন্তে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম এই অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী বলে জানায় পুলিশ। এসব জঙ্গিদের অনেকেই ধরা পড়ে কারাগারে আটক ছিলেন। যারা শেখ হাসিনার পতনের পর জামিনে বেরিয়ে এসেছেন।
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় সিরিয়াভিত্তিক ইসলামিক স্টেটের স্থানীয় সমর্থক পাঁচ জঙ্গি। এই হামলায় ২০ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে দেশি ও বিদেশি নাগরিক ছিলেন। কাউন্টার অপারেশনে পাঁচ জঙ্গিও নিহত হয়।
এই ঘটনার পর সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে হত্যা করা হয় শীর্ষ জঙ্গিদের। তবে পুলিশ-র্যাবের হাতে নিহত এই সকল নিহতরা সবাই জঙ্গি ছিলেন না বলে মনে করেন অনেকে।
সাংস্কৃতিক উৎসবের বিরুদ্ধে হুমকি
গত শুক্রবার স্থানীয়দের বাধায় মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলায় প্রয়াত বাউল আব্দুর রশিদ বয়াতির বাৎসরিক ওরশ পণ্ড হয়েছে।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি হেফাজতে ইসলামের বাধায় বন্ধ হয়ে যায় টাঙ্গাইলের মধুপুরে লালনের মৃত্যুবার্ষিকী উৎসব। তবে ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনের হস্তক্ষেপে অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়।
১৫ ফেব্রুয়ারি একই জেলার ভুঞাপুরে বসন্ত উৎসব উপলক্ষে ফুল বিক্রি নিয়ে “তৌহিদি জনতা” দোকান ভাংচুর করে। এই ঘটনার পর পাশের গোপালপুরে উপজেলায় নির্ধারিত ঘুড়ি উৎসব বন্ধ হয়ে যায়। বাধার মুখে বাতিল হয় ঢাকার উত্তরায় উন্মুক্ত মঞ্চে বসন্ত উৎসবও।
১১ ফেব্রুয়ারি একদল “ইসলামী নেতা” একুশে বইমেলায় স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি ও এর প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধের হুমকি দেয়।
এর আগের দিন সন্ধ্যায় ‘সব্যসাচী’ প্রকাশনার স্টলে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বই বিক্রিকে কেন্দ্র করে স্টল ভাঙচুরের পর পুলিশ প্রকাশক শতাব্দী ভবকে আটক করে। পরে রাত ১২টার দিকে মুচলেকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়।
ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে ১৩ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে কবি সোহেল হাসান গালিবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় বাদ্যযন্ত্র বাজানো ও হিজড়া-হকার প্রবেশ নিষিদ্ধের নোটিশ দেওয়া হয়, পরে ছিঁড়ে ফেলা হয়।
গত মাসে জয়পুরহাটে মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট ভাংচুর করে “তৌহিদি জনতা”, তবে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সমস্যা মিটে যায়।
ধর্মনিরপেক্ষতা সমর্থন করি না: হেফাজতে ইসলাম
এদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষে নিজেদের অবস্থান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সবচেয়ে বড়ো সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।
সংগঠনটির নায়েবে আমীর (ভাইস প্রেসিডেন্ট) মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী বুধবার বেনারকে বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতে রয়েছে। সেখান থেকে আমাদের এখানে আনা হয়েছে। কিন্তু আমরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমর্থন করি না অথবা উৎসাহ দেই না। আমরা বিশ্বাস করি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম।”
“তবে তার অর্থ এই নয় যে অন্য ধর্মের মানুষের অধিকার হুমকির মুখে পড়বে,” বলেন তিনি।
ভুল জঙ্গি দমন কৌশল
বাংলাদেশে মহিলা জঙ্গিদের নিয়ে গবেষণা করে জার্মান গবেষক ইয়াসমিন লরশের সাথে যৌথভাবে বই লিখেছেন সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ।
তিনি বেনারকে বলেন, “বর্তমানে জঙ্গিরা মুক্তভাবে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ পুলিশ, র্যাবসহ কারও কোনো তৎপরতা নেই। তারা এখন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দিচ্ছে।”
শেখ হাসিনার আমলে জঙ্গি দমন কৌশল “ভুল এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত” ছিল উল্লেখ করে আজাদ বলেন, “গবেষণায় আমি দেখেছি, জঙ্গি হিসাবে যাদের মিডিয়ায় উপস্থাপন করা হয়েছে, তাদের অনেকেই ছিল নিরপরাধ।”
“তবে শেখ হাসিনার পতনের পর কেউ কেউ প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে, সকল জঙ্গি অথবা উগ্রবাদীরা নিরপরাধ ছিল। সেটিও ঠিক নয়,” বলেন তিনি।
দীর্ঘ মেয়াদে দেশে জঙ্গি আক্রমণের আশঙ্কাও করছেন আবুল কালাম আজাদ।
বাংলা ভাই নামে পরিচিতি শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি সিদ্দিকুর রহমানের উত্থানের সময় রাজশাহীর কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বুধবার বেনারকে বলেন, “উগ্রবাদী সহিংস ধারণা চলে যাবে না। ভালো হোক অথবা মন্দ হোক কোনো আদর্শকে শক্তি প্রয়োগ করে শেষ করা যায় না।”
নূর মোহাম্মদ বলেন, শেখ হাসিনার আমলে সঠিক বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের হত্যা অথবা দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। সরকার পতনের পর বিচারিক প্রক্রিয়ায় তারা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে।”
যা বলছে সরকার
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বুধবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে সহিংস উগ্রবাদী ধারণার কোনো স্থান নেই—এটাই আমাদের সরকারের অবস্থান। সহিংস উগ্রবাদী কার্যক্রম প্রতিরোধ করতে আমাদের এন্টি-টেররিজম ইউনিট, কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট এবং অন্যান্য এজেন্সি কাজ করছে।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে মানুষ ভয়ডরহীনভাবে তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে। আমরা প্রকৃত অর্থেই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই যেখানে কোনো ভয় অথবা পূর্বাগ্রহের স্থান থাকবে না।”
Copyright ©2015-2024, BenarNews. Used with the permission of BenarNews.