মোস্তফা ইউসুফ ও আব্দুর রহমান/ঢাকা ও কক্সবাজার

পক্ষাঘাতগ্রস্ত পা নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা মো. হাসান। তিনি নিয়মিত যেখানে ফিজিওথেরাপি নিতেন, সেই চিকিৎসা কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিজের চলৎশক্তি ফিরে পাওয়া নিয়ে উৎকণ্ঠায় ভুগছেন।
২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জাতিগত নিধন শুরুর পর ৪০ বছর বয়সী হাসান গুলিতে নিজের এক পা হারান। এরপর হাসানের অন্য পাও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার মতো হাসানও আরাকান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেন। সেখানকার একটি এনজিও পরিচালিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তিনি ফিজিওথেরাপি নিতেন। চিকিৎসার মাধ্যমে তাঁর পক্ষাঘাতগ্রস্ত পায়ে ভর দিয়ে একদিন দাঁড়াতে পারবেন—সে স্বপ্ন দেখতেন হাসান। তাঁর সে স্বপ্ন এখন ধূলিসাৎ হওয়ার পথে।
“আমি হ্যান্ডিকেপ পরিচালিত স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ফিজিওথেরাপিসহ অন্যান্য চিকিৎসা পেয়ে আসছিলাম। আশায় ছিলাম একদিন আমি এক পায়ে হাঁটতে পারব। এখন হ্যান্ডিকেপে সেবা দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, সাথে আমার আশায়ও শেষ,”বেনারনিউজকে বলেন হাসান।

স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত ৭০ হাজার শরণার্থী
বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএআইডি’র কার্যক্রম স্থগিত করার কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে একের পর এক হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যসেবা থেকে প্রায় বঞ্চিত হচ্ছেন ৭০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা। সামনে বন্ধ হয়ে যেতে পারে আরও বেশকিছু হাসপাতাল ও ক্লিনিক।
তাঁরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা ৯০ দিনের জন্য স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এক নির্বাহী আদেশে এসব সহায়তা পুনর্মূল্যায়নের জন্য ৯০ দিনের স্থগিতাদেশ দেন।
এ স্থগিতাদেশের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্যানিটেশন, পানি ও জীবিকা অর্জনের অনেক কর্মসূচি বন্ধ হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির আদালতে দেশটির সরকারের উপস্থাপন করা এক নথি বেনারনিউজ দেখেছে, তাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন সরকার বলছে, ফেডারেল কোর্ট স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করতে বললেও সেটা তারা করবেন না। এক রিটের জবাবে সরকার এ নথি উপস্থাপন করেছিল।
শরণার্থী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির পরিচালিত তিনটি হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। আরও দুটি হাসপাতাল মার্চের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়াও প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া ১৪ সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) বন্ধ হয়ে গেছে।”
শরণার্থী কমিশনার বলেন, “এসব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত ৭০ থেকে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা সেবা নিতেন। রোহিঙ্গা শিবিরে মোট ১২০টি হেলথকেয়ার সেন্টার আছে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড়ো তহবিলদাতা, তাদের এ সিদ্ধান্ত নানা সেক্টরে সমস্যা তৈরি করবে।”
মিজানুর রহমান জানান, “সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এসব ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন আমরা কম রিসোর্স দিয়ে সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার পরিকল্পনা করছি।”

‘রোগীরা কঠিন সময় পার করছেন’
বেনারনিউজ কয়েকটি সিডিডি সেন্টার ও হাসপাতাল ঘুরে দেখে এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালে সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার চিত্র দেখেছে।
সরকারি হাসপাতালে কর্মরত একজন চিকিৎসক বেনারকে জানিয়েছেন, হ্যান্ডিকেপ ইন্টারন্যাশনাল, যেখানে হাসানের মতো রোগীরা সেবা নিতেন সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
টেকনাফ উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা এনামুল হক বেনারনিউজকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের সেবা দেয়া আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি )কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে গেছে।”
গত ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি বলেন, “এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রোগীরা কঠিন সময় পার করছেন। সরকারি হাসপাতাল ছাড়া এ মুহূর্তে তেমন কোনো হাসপাতাল নাই।”
“এ মুহূর্তে তাঁদের কোনো জায়গা নেই। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গরিব রোগীরা,” বলেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে বেনারনিউজের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সিডিডির সাথে যোগাযোগ করে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে তহবিল স্থগিতের কারণে কোনো কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবার তথ্য নাকচ করেছে আইসিডিডিআর,বি।
এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির ডেভেলপমেন্ট ও কমিউনিকেশন ম্যানেজার এ.কে.এম তরিফুল ইসলাম খান বুধবার এক ইমেইলে বেনারকে জানান, “রোহিঙ্গাদের সহায়তায় আমাদের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। তহবিল সংকটে রয়েছে আমাদের এমন কোনো কার্যক্রম সেখানে নেই।”

প্রভাব পড়েছে স্থানীয়দের ওপরেও
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্যখাতে কাজ করেন এমন একজন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যে সকল প্রতিষ্ঠান আছে, তারা সবাই ২০-২৫ শতাংশ সেবা হ্রাস করেছে। কারণ, ইউএসএআইডির তহবিল স্থগিত হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অনেক কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিওদের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক প্রতিষ্ঠান ইন্টার সেক্টর কোর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) বেনারকে এক বিবৃতিতে জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সেবা বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়টি তারা পর্যবেক্ষণ করছে।
“ক্যাম্প ও হোস্ট কমিউনিটিতে জীবন রক্ষাকারী সেবাসহ বেশকিছু সেবা বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি”, বিবৃতিতে বলা হয়।
আইএসসিজির জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ মো. তাফহিমকে উদ্ধৃত করে বিবৃতিতে বলা হয়, “বিভিন্ন সেক্টর যেমন স্বাস্থ্যসেবা যার অন্তর্ভুক্ত প্রতিবন্ধীরাও ছিল, পানি, স্যানিটেশন, শিক্ষা ও জীবিকা- এসবে প্রভাব পড়েছে।”
“বৈদেশিক সাহায্য স্থগিত হওয়ার কারণে প্রয়োজনীয় ও জীবন রক্ষাকারী সেবাসহ বেশকিছু সেবা বন্ধ হয়ে গেছে, যা রোহিঙ্গা ও হোস্ট কমিউনিটিতে প্রভাব ফেলছে”, বিবৃতিতে জানানো হয়।
বিবৃতি জানায়, “কিছু সহায়তা স্থগিতাদেশ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সাথে যোগাযোগ চলছে। কিন্তু রোহিঙ্গা শিবিরে এর (স্থগিতাদেশ) প্রভাব স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে কী রকম হতে পারে তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে সময় লাগবে।”
জাতিসংঘের পপুলেশন ফান্ডের বাংলাদেশ প্রতিনিধি মাসাকি ওয়াতাবে এক বিবৃতিতে বলেন, “রোহিঙ্গাদের সহায়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দীর্ঘদিনের মিত্র। আমরা কৃতজ্ঞ ও একইসঙ্গে আশা করি বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের মর্যাদা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় জরুরি সেবা নিশ্চিতে তহবিল সহায়তা পুনরায় শুরু হবে।”

‘অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছি’
তারপুলিন আর বাঁশের তৈরি একটি ছোট ঘরে কবির হোসেন তাঁর পক্ষাঘাতগ্রস্ত ছেলেকে নিয়ে থাকেন। পক্ষাঘাত ছাড়াও আরও কিছু জটিলতায় ভুগছে তাঁর সন্তানটি।
“সন্তানকে নিয়ে প্রতি দশদিন পর পর আমার সিডিডি সেন্টারে আসতে হয় চিকিৎসা ও ওষুধের নেয়ার জন্য। কিন্তু গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের সেবা বন্ধ হয়ে গেছে,” বেনারকে বলেন কবির হোসেন।
“আমি এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছি। কোথা থেকে আমার সন্তানের চিকিৎসা করাব এখন বুঝতে পারছি না”, বলেন তিনি।
Copyright ©2015-2024, BenarNews. Used with the permission of BenarNews.